
‘অনেক দিন পরে আজ আমি তোমাদের সম্মুখে এই মন্দিরে উপস্থিত হয়েছি। ...যে কারণেই হোক,তোমাদের মন এখন আর প্রস্তুত নেই আশ্রমের সকল অনুষ্ঠানের সকল কর্তব্যকর্মের অন্তরের উদ্দেশ্যটি গ্রহণ করতে, এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই।এর জন্য শুধু তোমরা নও,আমরা সকলেই দায়ী।’বাংলা ১৩৪৭ সালে এ কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।আজ ১৪১৬ সালে (২০১০) বসন্ত উত্সবের দিনেও সেকথা একি ভাবে সত্য। বন্ধ করে দিতে হল বাঙ্গালীর গর্বের শান্তিনিকেতনের সন্ধ্যাকালীন অধিবেশন।
বিশ্বভারতীর শুরুর উদ্দেশ্য ছিল সমবায়-এর মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান ছাত্র,শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগ রেখে,দেশের অর্থ,কৃষি,স্বাস্থ্যবিদ্যা ও তার সব ব্যবহারিক বিঞ্জানের সব শিক্ষাকে প্রয়োগ করে দেশের কেন্দ্রস্থল অধিকার করবে।না হোলে দেশের উন্নতি নেই।এই জন্য এর নাম বিশ্বভারতী রেখেছিলেন রবিবাবু।বিশ্ব আর ভারতের যোগাযোগ হয়েছে বটে,কিন্তু সে অসাম্যের যোগ,লেজুড় হবার যোগ,মাথাউঁচু করার যোগ হলনা।সমবায়?শিক্ষার প্রয়োগ?চারদিক নিয়ে?এই খোলা বাজারে ভোলা মন কি বল?
এখন আদর্শ শিক্ষা হল যা পয়সা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় তা।এবারে যা কেনা হবে তাতো বিনিয়োগ হিসেবেই থাকবে,তার একটা ফেরত চাই।কাজেই সেখানে সমবায় ভাবনা একটি অলীক চিন্তা।নিজের উন্নতি,মানে বাড়ি-গাড়িই একমাত্র চিন্তা।রবিবাবু ভেবেছিলেন কালে কালে বিঞ্জানের যাবতীয় পড়াশুনো বাংলায় হবে।নিজে একটা বিশ্বকোষ লিখে ফেললেন সূচনা হিসেবে।কিন্তু তাও হয়নি।শ্রীনিকেতন করলেন যে ভাবনা নিয়ে তাও বৃথা।ধান কত রকম হত এ দেশে তাও এই মুহুর্তে পরিস্কার জানা নেই আমাদের।অথচ জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড বেগুন চাষে মুক্তি সরকার বুঝে গ্যাছে!কিছুদিন আগেও নিম-হলুদের পেটেন্ট নিয়ে যাচ্ছিল অন্য দেশ, আমরা ঘুমোচ্ছিলাম।
এই বাংলায় এখন শিল্প মানে হল আইটি,যাতে অন্য দেশিয় কোম্পানী তার গ্রাহকের সুবিধা-আসুবিধা নিয়ে কথা বলার জন্য একদল ছেলে-মেয়ে ভাড়া করে,যারা মার্কিন বা ব্রিটিশ ঘেঁষা ইংরেজীতে কথা বলবে নিজের বংশগত নামকে পল,ডিক বা হ্যারী করে।তাদের অমন ইংরেজী চোট্টামি শেখাবার জন্য শুধু কলকাতা নয়, বাঁকুড়া, বীরভূম,বর্ধমান,পুরুলিয়া,জলপাইগুড়ি সর্বত্র স্পোকেন ইংলিশের কেন্দ্র হয়েছে।এও আরেক বিশ্বভারতী,তবে রবিবাবুর নয়।এখানে বিত্তের গল্প,চিত্তের প্রসার নিয়ে ভাবনা নেই।তিন থেকে ছ’মাস দিনে চোদ্দো থেকে ষোল ঘন্টা কাজ করে এরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ছেড়ে দেয়।তার আগে এই বিজাতীয় ভাষা শিখতে তারা কয়েক হাজার খরচা করে ফেলেছে,তার কদাচিত্ ফেরত হলেও বাড়তি কিছু থাকেনা হাতে।নতুন ছেলে-মেয়েরা ততোদিনে এদের জায়গা নিতে এসে গ্যাছে।
আরেকটা শিল্পপদ্ধতি নিয়ে খুব কথা হচ্ছিল কদিন।বিদেশ অথবা ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে যন্ত্রাংশ আসবে, সেখানে একদল কর্মী তাকে জুড়বে।জলের দামে জমি দিয়ে (কোথাও এর ব্যাতিক্রম হলে সেটা খবর, বেশিটাই একি রকম বলে বোধহয় খবর নয়) কারখানা শুরুর বিশ বা তিরিশ বছরের ট্যাক্স ছাড়ের পর, যন্ত্রাংশ উত্পাদন হবেনা বলে শুধু জোড়ার ট্যাক্স পাবে রাজ্য সরকার।মানলে রাজ্যসরকার খারাপ জনগণের কাছে (তাকে অন্য রাজ্যর সঙ্গে পাল্লা দিতে হয় শিল্প গড়তে), না মানলে খারাপ শিল্পপতিদের কাছে (তারা শুধু সুবিধাই নেবে, দেবেনা)। কোন শ্রমিক আইন ওখানে চলবেনা,কাজের ঘন্টা মাপা যাবেনা।ছেড়ে দিন সেসব কথা,এই জোড়ার কাজে লাগবে খুব সামান্য শ্রমিক,কারণ বেশিটাই করবে যন্ত্র।তবে একদল লোক আসবে এখানে, থাকবে।কাজেই তাদের বাড়ীতে ফাই-ফরমাস খাটা থেকে কাজের লোক থেকে তাদের ইলেক্ট্রিক বা জলের মিস্ত্রি, রিক্সাওয়ালা এসব কাজ থাকবে স্থানীয়দের।একেই বলে শিল্পোন্নয়ন।
বোলপুরের পুরোনো একটা গল্প বলি শুনুন। শ্রীনিকেতন থেকে এক ব্যাক্তি বই বাঁধাই-এর কাজ শেখেন স্বাধীনতার কিছু পরে পরে।তিনি স্টেশনের কাছে একটি ছোট্ট দোকান নিয়ে কাজ করতেন।শান্তিনিকেতন-এর সঙ্গে জড়িত এক ভদ্রলোক তাঁকে বলেন এর সঙ্গে ছবি বাঁধাই-এর কাজ করতে। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সে কাজ শেখেন সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য।সারাদিন বই বাঁধাই,আর সারারাত ছবি বাঁধাই চলত।করতে করতে কাঁচ আনতে শুরু করেন বর্তমান ঝাড়খন্ড,তখনকার বিহার থেকে।বাড়িতে মেয়েকে শিখিয়েছিলেন রবিবাবুর গান।স্নাতক,আইনজীবি ছোট ছেলে তার চমত্কার সুরেলা কন্ঠে তুলে নিয়েছে সে গান।কাঁচের ব্যবসার জন্য সারাদিন গোডাউনে পড়ে থাকে,দোকানে বসে দাদার সঙ্গে আর রাত্রে গাইতে শুরু করে ‘একি লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ প্রাণেশ হে’।নাতি পদার্থবিদ্যায় স্নাতকস্তরে পড়ছে।গবেষণা করবে বলছে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে।পেলেন,বিঞ্জান এবং আশপাশ কিভাবে যোগ হতে পারে তার প্রমাণ?ওই সত্তর বছরের ঋজু বৃদ্ধ আজো বহু মানুষকে সাহায্য করেন।তারা তা নষ্ট করলে ছেলে-মেয়েরা রেগে যায়।বৃদ্ধ বলেন আমার কাজ সাহায্য করতে থাকা, একজন না করলে আরেকজন ঠিক করবে কোন না কোন দিন।থেমে থাকা যাবেনা।কমরেড,এটি রবিবাবুর শিল্পোন্নয়নের ফলিত চেহারা।
যে ছাত্ররা দোলের দিন একাজ করল,দোষ তাদের না।ক্ষমতালোভী কর্তৃপক্ষ,বিদ্যালয়কে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত যাবতীয় রাজনৈতিক দলের এ চেহারা কি রবিবাবু নিজে দেখে যাননি?এমনি এমনি এত কষ্ট করে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে শেষ জীবনে দূরে ছিলেন?সুভাষ থেকে গান্ধী সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এর আদর্শ,কিন্তু কাজ তেমন হয়নি।রাষ্ট্র বিপ্লবের চেহারা সবাইকে মুগ্ধ রেখেছে,সমাজবিপ্লবের আবশ্যিকতা রবিবাবুর কবির খেয়াল বলে উবে গ্যাছে।কি বলেছিলেন জানেন ১৩৪২-এর ৮-ই পৌষ-এ?‘শিক্ষার যে-সব প্রনালী সাধারণত প্রচলিত,বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি,সেইগুলোই বলবান হয়ে ওঠে,তার নিজের ধারা বদলে গিয়ে হাই-ইস্কুলের চলতি ছাঁচের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে,কেননা সেই দিকেই ঝোঁক দেওয়া সহজ...।’ভাল লাগেনি তাঁর বিশ্বভারতীকে সাধারণের রুচির অনুবর্তী করে তোলার চেষ্টা।বারবার বলেছেন জনগনের উন্মাদনার বাইরে আসতে। কন্সটিট্যুশন দিয়ে বিদ্যালয় চালাবার ইচ্ছে তাঁর ছিলোনা।কেউ শোনেন নি।তাঁদের পরবর্তী শিক্ষকদের ছাত্রদের সঙ্গে না মেশা,দূর থেকে চালানোর পদ্ধতিতে সমগ্রের সঙ্গে কর্মীর অন্তরের যোগ গড়ে না ওঠা নির্দেশ করছেন বারবার।কড়া সমালোচনা করছেন;কাজ শুধু দক্ষ হলেই হবেনা, তাতে আদর্শের সঙ্গে সংযোগ থাকছে কিনা দেখা দরকার বলছেন, কিন্তু কে শোনে?ভেতরেই তাঁর কথা শোনা হয়নি,কবির ইচ্ছে বলে দূরে রাখা গ্যাছে।তাতে পরিশ্রম বেঁচেছে, আরো বেশী করে দলাদলির সুযোগ পাওয়া গ্যাছে,বিশ্বভারতী আর রবিশিল্প দিয়ে অনেক আখের গোছানো গ্যাছে।অনেক নির্বোধ,মাননীয় বুদ্ধিজীবি হয়েছেন রবিবাবুর কর্মকে কুক্ষিগত করে রাখার সুবাদে।আর কি চাই? এখন লড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পে-স্কেলের,পছন্দের ছাত্র-ছাত্রী ঢোকানোর একচেটিয়া অধিকারের।একেই বলে সমাজসেবা। এই আদর্শ শিক্ষা।
আরো বলেছিলেন,‘সাধ্যের বেশি অনেক আমাকে এর জন্য দিতে হয়েছে,কেউ সে কথা জানে না...বিদ্যালয় যদি হাই-ইস্কুলে মাত্র পর্যবসিত হয় তবে বলতে হবে ঠকলুম...’। রবিবাবু এঁরা আপনাকে ঠকাতে সদাতত্পর ছিল,আপনি শুধু বোঝেননি। তবে বাংলাদেশ অনেক বড়,তার ভুগোল পেরিয়েও তার বিস্তার। সে আপনাকে ঠকায়নি,ঠকাতে পারেনা।দরিদ্র, সেই মহত বাংলা এককোণে নিভৃত সাধনে নিমগ্ন।হাজার বছর পরে হলেও সেই আপনার মুখ রাখবে,আপনার সন্মান রাখবে।বড় কাজ ক্ষুদ্রের ক্ষুদ্রতায় বিফল হয়না,এইতো আপনারো ইতিহাসের শিক্ষা।সভ্যতায় সংকট থাকে বলে সভ্যতা উবে যায়না।
No comments:
Post a Comment